Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ছবি
শিরোনাম
সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ
বিস্তারিত

প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ আব্দুর রাহমান হানাফী (রাঃ)।

বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ কুমিল্লা, নরসিংদী, গাজিপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সিলেটে আলো ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে কুসংস্কার ও হিন্দুয়ানী চালচলন থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে যে সকল মহা মনিষী ধর্ম প্রচারে অনন্য অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে কুমিল্লা (উত্তর জেলার ) মুরাদনগর থানাধীন সোনাকান্দার পীরসাহেব নামে খ্যাত হাফেজ আব্দুর রাহমান হানাফী (রাঃ) অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মহান আধ্যাত্মিক সাধক অনগ্রসর উত্তর কুমিল্লার অশিক্ষীত ও কুসংস্কারে জর্জরিত জনগোষ্ঠীকে ইসলামী শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষীত করা ছাড়াও কুসংস্কার মুক্তকরণে অনন্য অবধান রেখে গেছেন। শুধু কুমিল্লায় নয় বরং মেঘনা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল অর্থাৎ চাঁদপুর, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সিলেট জেলার ভাটী অঞ্চল আজমিরী, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, শায়েস্তাগঞ্জ এলাকা ইসলামী শিক্ষা ও সঠিক আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রসারে এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারে তিনি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী একজন মহান আধ্যাত্মিক সাধক, সত্যিকারের আলেমে দ্বীন, সমাজ সংস্কারক, ইসলামি সাহিত্যিক, আল্লাহ্‌র পথের মহান পথ প্রদর্শক এবং নির্যাতিত মানুষের আশ্রয়স্থল। অত্যাচারী ব্রিটিশ বেনিয়া ও হিন্দু জমিধারী মারওয়ারী নিষ্পেশনে জর্জরিত নিপীড়িত বাংলার মানুষকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সঠিক অবস্থানে তুলে আনার ক্ষেত্রে উনবিংশ শতকের অন্যতম সংস্কার আন্দোলন ফুরফুরা সংস্কার আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম একনিষ্ঠ সিপাহশালার।

তার বিনয়ী ও অমায়িক আচরন এবং আধ্যাত্মিকতার সম্পুরন ও হৃদয়গ্রাহী ওয়াজ নসিহতের কারনে তিনি আজও বৃহত্তর কুমিল্লাসহ সারা বাংলার আনাচে কানাচে তার কর্মপরিধী অঞ্চলের মানুষের হৃদয় বন্দরে অমর হয়ে আছেন। হাফেজ মাউলানা আব্দুর রাহমান হানাফী (রাঃ) বাংলা ১৩০৬ সনের মাঘ মাস মোতাবেক ১৯০০ খ্রিঃ বতমান কুমিল্লা জেলার (তৎকালীন ত্রিপুরা) মুরাদনগর থানার সোনাকান্দা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি পরিবার ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম গাজী বংশে জন্মগ্রহন করেন। তার পূর্বপুরুষগন পূর্ব পাঞ্জাব অধিবাসী এক বিশিষ্ট শিক্ষীত ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের লোক ছিলেন। তৎকালীন একনিষ্ঠ মুসলমান, বিশিষ্ট যোদ্ধা ও আলেম দরবেশদের মধ্যে তাঁরা অন্যতম ছিলেন। ধর্মদ্রোহী, বিধর্মীদের সাথে তারা এক যোদ্ধে জয়লাভ করে সরকারীভাবে গাজী উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু বিধর্মীদের প্রাধান্য দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রভাব ও আক্রোশ উক্ত পরিবারের উপর পতিত হয়। ফলে গাজী পরিবার বিধর্মী শত্রুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হেদায়েতের বাণী নিয়ে পূর্ব বাংলায় হিজরত করেন। বর্তমান কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাধীন গাজীপুর নামক স্থানে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা গাজী ছিলেন বলে, তাঁদের নামানুসারে এ গ্রামের নাম রাখা হয় গাজীপুর। পীর সাহেব কেবলার পূরবপুরুষগণ বংশ পরম্পরায় গাজীপুরেই বসবাস করে আসছেন। তাঁদের বংশে বহু হাক্কানী আলেম ও বুজুর্গ লোক জন্মগ্রহন করেন। পীর সাহেব কেবলার তিনজন দাদার মধ্যে আপন দাদা গাজী আলী উক্ত গ্রাম ত্যাগ করতঃ সোনাকান্দায় এসে বসতি স্থাপন করেন। এর পূর্বে এ গ্রামে আর কেউ বসতি স্থাপন করেনি। বংশ পরম্পরা হল হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ), তাঁর পিতা শাহ সুফী গাজী আফসার উদ্দীন মুন্সী তাঁর পিতা শাহ সুফী গাজী আলী, তাঁর পিতা আয়িদা গাজী, তাঁর পিতা নাতওয়ান গাজী, তাঁর পিতা গাজী মুন্সী মোহাম্মদ রেজা।

হযরত পীর সাহেব কেবলার পিতার নাম শাহসূফী গাজী আফসার উদ্দীন (রাঃ)। তিনি একজন পরহেজগার তরীকতপন্থী বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ছিলেন এবং বাংলায় মাইনর পাশ ছিলেন। তিনি হাদিয়ে বাঙ্গাল হজরত মাউলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রাঃ) (১৮০০-১৮৭৩ খ্রীঃ )-এর সুযোগ্য পুত্র হজরত মাউলানা হাফেজ আহম্মদ জৌনপুরী (রাঃ) এর বিশিষ্ট মুরিদ ছিলেন। তিনি সোনাকান্দার পার্শ্ববর্তী গ্রাম শ্রীকাইল মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অত্র এলাকার মুসলিম হিন্দু শিক্ষীত সমাজ সকলেই ছিলেন তাঁর ছাত্র। ঐতিহ্যবাহী শ্রীকাইল ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর ভ্রাতা যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষা ও আইন মন্ত্রী এডভোকেট কামিনী দত্ত রায়ও ছিলেন তাঁর ভক্ত ও শিষ্য। ফলে হিন্দুরাও তাকে শ্রদ্ধা করতেন। সে হিসেবে সোনাকান্দার পীর হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) –এর প্রতিও শ্রীকাইলের হিন্দুগণ শ্রদ্ধাশীল আচরণ করত।

পীর সাহেব কেবলার বিদুষী মাতার নাম ছিল নাওয়াজা খাতুন। তিনিও এক রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারের কন্যা ছিলেন। পীর সাহেব কেবলার নানাজানও বিশিষ্ট আলেম ছিলেন এবং মোল্লা উপাধীতে ভূষিত ছিলেন। তাঁর নাম ছিল ইউসুফ মোল্লা। তিনি সোনাকান্দা গ্রামের পশ্চিম অদূরে ভূতাইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। তিনি নিজ হাতে আল কোরআন মাজীদ লিখে তা মুসলিম জনগণের মাঝে বিতরণ করতেন। তার হস্ত লিখিত একখানা আল কোরআন মাজীদ মরহুম পীরসাহেব কেবলার কাছে ছিল এবং তিনি তার ছেলে আবুবকর মুহাম্মদ শামছুল হুদাকে পড়ার জন্য দিয়েছিলেন। ইউসুফ মোল্লাও জৌনপুরী ছিলছিলার মুরিদ ছিলেন। পীর সাহেব কেবলার মাতা নাওয়াজা খাতুন স্বীয় পিতার নিকট হতে বিশুদ্ধভাবে আল কোরআন কারীম তেলাওয়াত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত চরিত্রবতী, খাসপর্দাশীল, পরহেজগার মহিলা ছিলেন। পীর সাহেব কেবলার জন্মের পূর্বে তাঁর এক ভাই জহির আহমেদ জন্মের পরই ইন্তেকাল করার বার বছর পর তার জন্ম হয়। জন্মের পরই পীর সাহেব কেবলার পিতা মাতা তাকে অত্যন্ত আদর যত্নের সাথে লালন পালন করেন এবং দ্বীনের জন্য তাকে উৎসর্গ করেন। আফছার উদ্দিন মুন্সীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন জ্যৈষ্ঠ। দীর্ঘদিন পর সন্তানলাভ এবং প্রথম সন্তান হওয়ায় জন্মের পর হতে তিনি আদুরে পরিবেশে প্রতিপালিত হন। দ্বীনি রক্ষনশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় শৈশবে তার মন মগজে দ্বীনি আবহ সৃষ্টি হয়। তার পিতাও শৈশবে তাকে একমাত্র দ্বীনি খেদমতের উদ্দেশে দ্বীনি শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। স্বীয় পিতা আফসার উদ্দীন মুন্সীর কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। তখন অত্র এলাকায় ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মক্তব মাদ্রাসা বলতে কিছুই ছিলনা। তাই ব্যক্তি কেন্দ্রিক পারিবারিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে হত। নিজে আরবি বর্ণমালা শিক্ষাদানসহ আরবী কায়দার পাঠদান শেষে পিতা আফসার উদ্দিন মুন্সী তাকে পার্শ্ববর্তী রাজনগর গ্রামে আম্বর আলী মুন্সীর নিকট মক্তব শিক্ষার জন্য পাঠান। এখানে তিনি কিছুদিন মক্তব শিক্ষা নেবার পর পার্শ্ববর্তী সাহেদাগোপ গ্রামে অবস্থিত মক্তবে পাঠানো হয়। আল কোরআন কারীম শিক্ষার পাশাপাশি তিনি অল্প সময়েই বাংলা, ইংরেজী, অংকসহ আরবী, উর্দু, ফারসী বিশয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। পীর সাহেব কেবলা কিশোর বয়সেই অগণিত পীর, বুজুর্গ, অলি ও অজ্ঞাতনামা দরবেশের দোয়া ও সাক্ষাৎলাভে ধন্য হন। যার জন্য তার জীবনের চলার পথ দিক নির্দেশনা এ সকল মহান বুজুর্গের দোয়া ও মূল্যবান নসীহত তাঁর জীবনকে সুষমামন্ডিত করার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছিল। কিশোর অবস্থায় তাঁর মধ্যে উত্তম গুনাবলী ও আত্মিক বিকাশের আভা বিকশিত হয়েছিল। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের ইসলামী শিক্ষা সফলভাবে সমাপ্ত করার পর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা অর্জনের জন্য পীর আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) চান্দিনা থানার হারং মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনি মাওলানা ইদ্রিস সাহেবের তত্তাবধানে পড়াশুনা করেন। জামাতে পানঙ্গম (বর্তমান দাখিল স্তর) পর্যন্ত তিনি হারং মাদ্রাসায় কৃতিত্বের সাথে পড়াশুনা করেন। এখান থেকে পানঙ্গম পাশ করার পর তিনি উচ্চশিক্ষালাভের জন্য ঢাকার তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় জামায়াতে চাহরমে (বর্তমান আলিমস্তর) ভর্তি হন। জামায়েতের চাহরম হতে উলা পর্যন্ত তিনি অত্র মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন এবং ইসলামী শিক্ষায় বিদগ্ধ পন্ডিত শিক্ষকদের সংস্পর্শে এসে ব্যাপক বুৎপত্তি অর্জন করেন। ছয় প্রকার বৃত্তিসহ ১ম গ্রেডের বৃত্তি নিয়ে তিনি ১৩৩০ বাংলা ১৯২৩ইং সনে হাম্মাদিয়া মাদ্রাসা হতে কৃতিত্বের সাথে জামায়াতে উলা পাশ করেন। এরপর বাড়িতে আসার পর তাঁর পিতা তাঁকে ক্বারীয়ানা পড়তে বলেন। পিতার নির্দেশে তিনি নোয়াখালির দৌলতপুর গিয়ে প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেম ক্বারী মুহাম্মদ ইব্রাহিম সাহেব (রাঃ) –এর নিকট দু-বছর যাবত ক্বারীয়ানা শিক্ষা গ্রহণ করেন। জাহের-বাতেন উভয় ইলমে পরিপূর্ণতা অর্জন ও উচ্চতর স্থান অর্জনের জন্য তিনি আরবদেশ সফর করেন। আরবদেশ সফরকালীন সময়ে মদীনা মুনাওয়ারায় তিনি প্রবিত্র আল কোরআন কারীম হিফয করেন এবং সিহাহ মিত্তার কিতাব দাওর করেন। অতঃপর সেখানকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে জাহের ও বাতেন উভয় ইলমে গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন। হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এর পূর্ণ জীবনীটাই ছিল কর্মমুখর। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল জনকল্যাণে , সমাজসংস্করনে নিবেদিত। অধ্যবসায়ের পর কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি জনকল্যাণ মূলক কর্মকেই প্রাধান্য দেন। দ্বীনি খেদমতকে পেশা হিসেবে গ্রহন করলেও পথহারা মানুষেকে সঠিক পথের সন্ধান দানের বিষয়েই তিনি ছিলেন ধ্যানমগ্ন, সমাজের অবহেলিত মানুষকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং দ্বীনের প্রচার ও প্রসারকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।

মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তব ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া এবং দাওয়াতী কাজ করে হেদায়েতের কাজ করাই ছিল তার মূখ্য উদ্দেশ্য। এজন্য তিনি মাসের পর মাস বাংলার গ্রাম হতে গ্রামান্তরে বেড়িয়েছেন এবং অগনিত মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বীনের এ কঠিন কাজে তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ঢাকা হাম্মাদিয়া মাদ্রাসা হতে জামাআতে উলা (বর্তমানে ফাযিল শ্রেণী) পাস করার পর ওস্তাদগণ তাকে হাম্মাদিয়া মাদ্রাসার খেদমত করার জন্য প্রস্তাব পেশ করেন । কিন্তু রসুলপুর গ্রামের বক্স আলী মৌলভী তাকে হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় না গিয়ে খাপুরা ,বাঙ্গরা,খামার গ্রাম এ তিন গ্রাম মিলিয়ে একটি ঈদগাহ করতে বলেন এবং এখানে একটি ক্বারীয়ানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী করে লেখা পড়া শিক্ষা দানের পরামর্শ দেন। শেষ পযর্ন্ত তিনি হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় না গিয়ে মত পরিবর্তন করে বক্স আলী মৌলভীর পরামর্শ গ্রহন করেন এবং ১৩৩২ বাংলা সনের চৈত্র মাসে বর্তমান খামার গ্রামে দাখিল মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। খামার গ্রামের হাসান আলী হাজী মাদ্রাসার জায়গা দান করেন। হুজুর কেবলা এ মাদ্রাসার নিয়মিত ছাত্রদেরকে পাঠ দান করতেন।

অবশেষে ১৩৪২ বাংলা সনে হুজুর কেবলা হজ্জে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করলে তার ভগ্নীপতি মাওলানা আব্দুল মজিদ সাহেবের কাছে মাদ্রাসার দায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। হজ্জ ও বিদেশসফর করে এসে পুনরায় সোনাকান্দার নিজ বাড়িতে তিনি সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ,দারুল হুদা বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা, খানকাহ্, লিল্লাহ বোর্ডিং, এতিমখানা মুসাফির খানা, মসজিদ, প্রাথমিক বিদ্যালয়, পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্বীয় পীর আবুবকর সিদ্দিকী আল কোরাইশীরের নির্দেশে ধর্ম প্রচার ব্রত হন। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অসংখ্য তালিমী সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জনকল্যাণ এবং পথ হারা মানুষেকে সঠিক পথের সন্ধান দানের কাজে তিনি কর্মময় জীবন অতিবাহিত করেন।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিজমা ধরে রেখেছিলেন এবং চাষাবাদ করে হালাল রোজগারের মাধ্যমে তিনি সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। অতি সাধারন মানুষের মতো জীবন যাপন করে তিনি ইসলামীক আদর্শকে সমুন্মত রেখেছেন যাতে করে খেটে খাওয়া মানুষ কাজ কর্ম করে ও কিভাবে ইসলামী আদর্শ বজায় রাখতে পারে তার একটি নমুনা পায়।তিনি ছিলেন দিন মজুর, চাষী ও খেটে খাওয়া মানুষের অনুপম আদর্শ। তিনি প্রায় তার ভক্ত মুরিদান ও এলাকার লোকদেরকে বলতেন ‘বাবা আমিওতো চাষাবাদ এবং খামার করি। এজন্য তো কোন দিন নামাজ কাযা হয়নি’ । গৃহস্থলি এবং চাষাবাদকে তিনি তার জীবিকা নির্বাহের মূখ্য উপাদান হিসাবে গ্রহন করে ছিলেন। এজন্য তাকে মানুষ ক্ষেতিপীর বলে ডাকত।

হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) ১৩৩৬ বাংলা,ইংরেজী ১৯২৯সনে কুমিল্লা ফোজদারী কাচারীর নিকটবর্তী জনাব আবদু মিঞা সাহেবের বাড়িতে মোজাদ্দেদে জামান আবুবকর ছিদ্দিকী(আল কোরাইশী) ফুরফুরাভী সাহেবের দস্ত মোবারকে তরিকতের বয়াত গ্রহন করেন। আবদু মিঞা সাহেব মুরাদনগর থানার ভবন ঘরের বাসিন্দা ছিলেন এবং মোজাদ্দেদে জামানের মুরিদ ছিলেন। হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফি (রাঃ) বাগদাদ শরীফ সফর কালে গাওছে পাকের আওলাদ তৎকালীন নকীব হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আহমেদ শরফুদ্দিন আল কাদেরী সাহেবের দস্ত মোবারকে তাবাররোকের বায়ত হন এবং কাদেরিয়া তরিকর খেলাফত প্রাপ্ত হন। ১৩৪৫ বাংলা সন মোতাবেক ১৯৩৮ ইং সনে আরব আযম সফর করে দেশে ফিরে আসার সময় মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) দিল্লী ও আজমীরের প্রবিত্র স্থান সমূহ যিয়ারত শেষ কলিকাতা আসেন তার মোরশেদ কেবলার সাথে সাক্ষাত করার জন্য। কলিকাতা পৌছে তিনি নাখেদা মসজিদেও মুসাফির খানায় রাত যাপন করে পরদিন বেল ৮টায় ৯নং হালদার লেনে একদিতলা বাড়ীতে হযরত আবুবকর ছিদ্দিকী আল কোরাইশী (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। ফুরফুরা হুজুর কেবলা মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এর আরব আযমের ভ্রমন বৃত্তান্ত শুনে সানন্দে মুনাজাত করেন। এর পর সংক্ষেপে কিছুদিন তরীকতের তালিম দেয়ার পর চার তরিকত তালিম দিবার নিমিত্ত এজাজত নামা দ্বারা তাকে খিলাফত প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে সোনাকান্দার পীর হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) ছিলেন ফুরফুরা হযরত আবুবকর ছিদ্দিকী (রাঃ) এর সর্বশেষ খলিফা।

পীর সাহেব হুজুরের পিতা আফসার উদ্দীন মুন্সীর তিন ছেলে দুই মেয়ে মোট পাঁচ জন সন্তান ছিল। তন্মধ্যে প্রথম ছেলে জহির উদ্দীন ছোট বেলাতেই মারা যায়। বাকী চার ছেলে মেয়ের মধ্যে পীর আব্দুর রহমান হানাফীই ছিল সবার বড়। পাঠরত আবস্থায় তাঁর পিতা তাকে পিতার বড় ছেলে হিসেবে বিয়ে করানোর জন্য পদক্ষেপ নেন এবং তাঁর পিতারই পীর ভাই মুরাদনগর টনকী নিবাসী জনাব মুন্সী আহসান উল্লাহ সরকারের মেয়ে মোহতারামা সাহেরা খাতুনের সাথে পরণয় সূত্রে আবদ্ধ করান। মুন্সী আহসানুল্লাহ সরকার ও মাওলানা হাফেজ আহমদ জৈানপুরী (রাঃ) এর মুরিদ ছিলেন। অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগম্বীর্যপূর্ণ রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে এবং তার পিতার পীর ভাই হিসাবে পূর্ব পরিচিত বন্ধুত্বের সূত্রে পিতার পছন্দেই তার বিবাহ সম্পাদিত হয়। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা এবং আদর্শ গৃহকর্তা।

দাম্পত্য জীবনে তিনি চার ছেলে এবং পাঁচ মেয়ের জনক। প্রথম মেয়ে মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন, দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল আউয়াল (কৈশরে মৃত), তৃতীয় মেয়ে মোসাম্মৎ জাহেরা খাতুন, চতুর্থ মেয়ে মোসাম্মৎ জামিলা খাতুন, পঞ্চম মোসাম্মৎ জোবেদা খাতুন (কৈশরে মৃত) ৬ষ্ঠ আবুবকর মোহাম্মদ শামছুল হুদা, ৭ম আবু সাইদ সুলতান আহমেদ, ৮ম সকিনা খাতুন, ৯ম আবু নসর মোঃ আব্দুল কুদ্দুস। সকিনা খাতুনের পর তার এক পুত্র সন্তান আব্দুল্লাহ মৃত জন্ম গ্রহন করেন।

শৈশব কাল হতেই মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এর চালচলন ও আচার আচরনে তাকওয়া পরহেযগারীর একটা আভা তার চেহেরায় ফুটে উঠেছিল। বাল্যকাল হতেই মুলকে আরবে সফর করার জন্য তার মন সর্বদা ব্যাকুল হয়ে উঠত। এ সম্পর্কে তিনি তার লিখিত আরবের সফর নামা গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তাই পবিত্র হজ্জ কার্য সমাধান ও আরব আযমের প্রবিত্র স্থান সমূহ যিয়ারতের উদ্দেশ্য ৩৬বছর বয়সে বাংলা ১৩৪২ সনের পৌষ মাসে মোতাবেক ১৯৩৫/৩৬ ইং সনে বাজমাত যুহরের নামাজ আদায় করতঃ পরিবার পরিজন ও মাদ্রাসার শিক্ষক ছাত্রগন হতে বিদায় নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে রওয়ানা হন। দীঘদিন জাহাজে থাকার পর জেদ্দা পৌছেন এবং মদীনা শরীফের প্রখ্যাত বুজুর্গ ব্যক্তি শেখ দাউদ তাফরুনী সাহেবের নিকট আল কোরআনুল কারীম হিফয করতে শুরু করেন। যিলহজ মাসের ২০/২৫ তারিখ হতে পরবর্তী বছর শাবান মাস পর্যন্ত ১৮ পাড়া আল কোরআনুল কারীম হিফয করে মক্কা শরীফে এসে তার মায়ের নামে দ্বিতীয় হজ্জ সম্পাদন করেন। বাকী ১২ পাড়া মক্কা শরীফে হাফেজ আব্দুল হক সাহেবকে শুনিয়ে মক্কা শরীফের পবিত্র স্থান সমূহ যিয়ারত করতে আরম্ভ করলেন। এরপর থেকে তার নামের সাথে হাফেজ সংযুক্ত হয়। মক্কা শরীফের সকল পবিত্র স্থান, মসজিদ, মাকবারা যিয়ারত করে তিনি ফয়ুজাতে রূহানী অর্জন করার পর মক্কা শরীফের তৎকালীন প্রখ্যাত ছোলতানিয়া মাদ্রাসায় ফখরিয়া মাদ্রাসায় আরেফিয়া ও সৌদিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত আলেমদের সংস্পর্শে কিছু দিন অবস্থান করে জাহের বাতেনের বিষয়ে ফায়েজ লাভে ধন্য হন। এর পর তিনি তায়েফ সফর করেন। তায়েফের পবিত্র স্থান সমূহ ও তিনি যিয়ারত করেন। এর পর তিনি মিশরে,বায়তুল মোকাদ্দাস,গাড়ে সোলাইমান,বায়তুল লাহাম বা বেতেলহাম, খলিলুর রহমান, কুদস হতে সাফাদ গমন, সাফাদ হতে সিরিয়া গমন, ইরাক, ইরান,বাগদাদ কারবালা,নাজাফ ,কুফা,বসরা মোমেল, ইত্যাদি বরকত পূর্ন স্থান সমূহ দর্শন এবং যিয়ারত করেন। তিনি আরব আযমে দীর্ঘ ৪বছর ব্যাপী অবস্থান করেন। হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) তার আরব জাহানের শেষ পর্যায়ে বসরা সফর করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা পোষন করেন। তাই তিনি বসরা হতে অবিনা নামক জাহাজে আরোহন করে ভারতে এসে উপস্থিত হন। যেখানে তিনি দশদিন অবস্থান করার পর আজমীর শরীফ, দিল্লী, কলকাতাসহ পাক ভারতের বিভিন্ন বরকতময় স্থানে দর্শন এবং আউলিয়া কিয়ামের মাজার যিয়ারত শেষে ফুরফুরা শরীফে তার মুরশিদ মোজাদ্দেদে জামান আবুবকর ছিদ্দিকী আল কোরাইশী(রাঃ) এর সংস্পর্শে থেকে তালিম লাভ করে খেলাফত প্রাপ্তির পর আরও কিছু দিন অবস্থান করে তার পীর ও মুর্শিদ কেবলার নির্দেশে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেন। পবিত্র ভূমি সফর শেষে তার পূর্ব স্মৃতি বিজড়িত দ্বীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খামার গ্রামে আগে গমন করেন। সেখানে রাত্রি যাপন করে দোয়া মোনাজাত করে পর দিন (৫ই আষাঢ় ১৩৪৫ বাংলা) তারিখে তার নিজ জন্মস্থান সোনাকান্দা নিজ বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। হুজুর কেবলা ১৩৪২ বাংলার পৌষ মাসে ৩৬ বছর বয়সে তিনি পবিত্র ভূমি আরব ও আজম সফরে বের হন অতঃ পর ১৩৪৫ বাংলার ৫ ই আষাঢ় তিনি দেশে প্রত্যবর্তণ করেন। (ইংরেজী সন ১৯৩৫ হতে ১৯৩৮ সন) সুদীঘ চার বছরে তিনি ৩ বার পবিত্র হজ্জকার্য সম্পাদন করেন এবং আরব ও আজমের পুন্যস্থান সমূহ যিয়ারত,আল কোরআনুল কারীম হিফয ও আধ্যাত্মিক সাধনায় অতিবাহিত করে শরীয়ত ও তরিকতের জ্ঞান বুৎপত্তি অর্জন করে ত্বরীকতের খেলফত লাভ করেন এবং একজন দাঈ ইলাল্লাহর দায়িত্ব নিয়ে দেশে প্রত্যার্বতন করেন। মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) ছিলেন একজন জ্ঞান পিপাসু মহান আধ্যাত্মিক সাধক। আধ্যাত্মিক সাধনা ও চেতনা বোধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুনের পথে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ার পদ্ধতিতে তিনি ছিলেন বিশ্বাসী। তাই তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত হননি। তবে আধ্যাত্মিক সাধক হলেও তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিত্ব। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না জড়ালেও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে, পাকিস্তান আন্দোলনে তার পরোক্ষ সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে ইসলাম আন্দোলনের সাথেও তিনি জড়িত হয়েছিলেন। হুজুর কেবলা তার জীবদ্দশায় মুসলমান জাতীকে এক করণের ব্যাপারে এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জনে মানুষের অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ করণের জন্য তৎকালীন সময়ে তিনি অরাজনৈতিক “আনজুমানে মঈনুল মুসলেমিন” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ)তরিকাঃ

মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, কাদেরিয়া চিশতিয়া এবং তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়ায় কামিল ছিলেন। তার পীর মুজাদ্দেদে জামান আবুবকর ছিদ্দিকী ফুরফুরাভী (রাঃ) হতে তিনি চার তরিকা এবং ত্বরীকানে মুহাম্মদিয়ার দীক্ষা পান এবং খেলাফত প্রাপ্ত হন। ১৩৩৬ বাংলা সনে তিনি ফুরফুরার মুজাদ্দেদে জামানের হাতে বায়াত গ্রহন করেন এবং ১৩৪৫ বাংলা মোতাবেক ১৯৩৮ ইং সনে তিনি খেলাফত প্রাপ্ত হন। তবে বাগদাদ শরীফ সফরকালে তিনি তৎকালীন নকীব গাউসে পাকের আওলাদ মাওলানা সাইয়্যেদ আহমদ শারফুদ্দিন আল কাদেরী নিকট কাদেরীয়া তরিকার তাবারোকের বায়াত গ্রহন করেন এবং এ তরিকার শিক্ষা দানের বিশেষ এজাযত প্রাপ্ত হন।

হাফেজ আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা সমূহঃ

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির আর্থ সামাজিক সংস্কৃতিসহ সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। সেই দিক লক্ষ্য রেখে হাফেজ আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) সুশিক্ষা দানে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে এগিয়ে আসেন। কুসংস্কার জর্জরিত উত্তর কুমিল্লায় অশিক্ষা বেহায়াপনা দূরীকরণ, সঠিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুন বিস্তারের লক্ষে এলাকায় তিনি অসংখ্য দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল।

** খামার গ্রাম দাখিল মাদ্রাসা।

হুজুর কেবলা তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুতেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নিতে তিনি প্রথম মুরাদনগর থানাধীন খামারগ্রামে ১৩৩২ বাংলা মতাবেক ১৯২৬ ইং সনে চৈত্র মাসে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

** খামার গ্রাম মসজিদ ও ঈদ্গাহ।

হুজুর কেবলা মাদ্রাসার পাশাপাশি তিনি একটি মসজিদ ও প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসা ও মসজিদের পাশাপাশি মাদ্রাসা ময়দানে একটি ঈদ্গাহও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। আজীবন তিনি এ ঈদ্গাহের ইমাম ছিলেন। হুজুর কেবলার ইন্তেকালের পর তাঁরই স্নেহভাজন সন্তান দরবারের পরবর্তী পীর মরহুম আবুবকর মুহাম্মদ শামছুল হুদা (রাঃ) পিতার নির্দেশমতে এ ঈদ্গাহের তত্ত্বাবধান ও ইমামতি করেছেন। আবুবকর মুহাম্মদ শামছুল হুদা (রাঃ) ইন্তেকালের পর তাঁর উত্তরসূরী স্নেহভাজন সন্তান বর্তমান সোনাকান্দা দরবার শরীফের পীর শাহ সূফী মাউলানা মাহমুদুর রহমান সাহেব পিতার নির্দেশমতে ঈদ্গাহের ইমামতি করে আছছেন এবং খামারগ্রাম খানকা মাদ্রাসা ও মসজিদের সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন।

** সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ ও বহুমুখী কামিল মাদ্রাসাঃ

অত্যাচারী ব্রিটিশ ও হিন্দুয়ানীর প্রভাবে এ দেশের মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতি ও সামাজিক অবস্থা ছিল নিষ্পেষিত। মুসলমানগণ হিন্দু জমিদারদের দাপটে নিজেদের সংস্কৃতিক অস্তিত্ব ভুলেই গিয়েছিল। বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে অত্র সোনাকান্দা এলাকাও এর চেয়ে বেতিক্রম ছিলনা। অত্র এলাকার মধ্যে শ্রীকাইল গ্রাম ছিল হিন্দুদের পবিত্রতম স্থান। এছাড়া আশপাশের গ্রাম এলাকাগুলো ছিল অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। গান বাজনা, ঢোল, তবলার আসর। রাত্রে কোন মানুষজন এসবের জন্য ঘুমাতেও পারতনা। এ ছিল আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এলাকার অবস্থা। এজন্য তিনি প্রাথমিক জীবনে এলাকায় না থেকে মুরাদনগর থানাধীন খামার গ্রাম গিয়ে মাদ্রাসা স্থাপন করেন। কিন্ত সেখানে গিয়েও তিনি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেননি।

১৩৪৫ সনে হজ্জব্রত পালন সহ আরব আযম সফর করে আসার পর তিনি নিজ এলাকার মুসলমানদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থা দেখে খুবই র্মমাহত হন। পূর্ণ ইসলামী জীবন যাপনে এলাকার মানুষের পক্ষ হতে বিভিন্ন রকমের অত্যাচার নিপীড়ন ও বাধা বিপত্তির কারণে তিনি কয়েকবার নোয়াখালী অঞ্চলে চলে যাওয়ার ইচ্ছ পোষণ করেন। কিন্তু মহান আল্লাহ পাকের মঞ্জর তিনি তার এ বান্দাকে দিয়ে অনুন্নত ও তমস্থন বিবর্জিত ধর্মীয় অনুভূতিহীন এলাকায় ইসলাম শিক্ষা ও আদর্শে বাতি জ্বালাবেন তাই তার মনকে নিজ এলাকায় দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আরব আযম সফর শেষে স্বীয় মুর্শিদ ও বাগদাদ শরীফ হতে খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে এবং আরব আযমে পবিত্র স্থান সমূহ জিয়ারত করে আধ্যাত্মিক শক্তিকে শানিত করে আসার ফলে তার ভাবগর্ম্ভীতা বেড়ে গেল। তিনি নিজ এলাকায় হিদায়েতের বাতি জ্বালানোর মনস্থির করলেন।

** সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ ও বহু মুখী কামিল মাদ্রাসা মারকাজ প্রতিষ্ঠাঃ

হুজুর কেবলা ভাবতে লাগলেন কি করে এহেন অনভিজ্ঞ মুসলমানকে জাহের ও বাতেন উভয় প্রকার ইলমের তাৎপর্য,গুরুত্ব,প্রয়োজনীয়তা ও আদর্শরূপে উপলব্ধি করানো যায়। এ ভাবনার মাধ্যমে তার অন্তরে এক নতুন স্পন্দন জেগে উঠল। এ স্পন্দন প্রেরণায় তিনি অগ্রসর হতে লাগলেন। মহান আল্লাহর উপর অবিচল অস্থা রেখে তিনি তার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে হাত দিলেন একটি মূল সূত্র স্থীর করে। এ সূত্রই হচ্ছে সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ। যেখানে তিনি পর্যায়ক্রমে মসজিদ, মাদ্রাসা, প্রাইমারী স্কুল, কুতুব খানা, খানকায়ে ছিদ্দিকীয়া, লিল্লাহ বোর্ডিং ও মুসাফির খানা, দারুল হুদা কবরস্থান স্থাপন করেন এবং এ মূল আর্কষনই হচ্ছে বর্তমান সোনাকান্দা দারুল হুদা বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা।

বর্নিত প্রতিষ্ঠান সমূহের ভিত্তি স্থাপনের জন্য মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) সর্ব প্রথম স্বীয় পৈত্রিক সম্পত্তি হতে এক একর এগার শতাংশ অর্থাৎ তিন কানী চৌদ্দ গন্ডা জমি রেজিষ্ট্রিকৃত ওয়াকফ নামা দলীল মূলে দান করেন। এর পর এ মারকাজের ভূমি পরিসর বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় পৈত্রিক পুকুরের সিকি অংশ নিজ নাল ভূমি ও আল্লাহর কতিপয় আশেকীনের অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে খরিদকৃত সম্পদ সহ মোট সাড়ে একুশ কানি (২১.৫)জমি রেজিষ্ট্রিকৃত ওয়াফকনামা দলিল মূলে দান করেন। বাংলা ১৩৪৭ সালের ৫ইং পৌষ মোতাবেক ১৯৪০ ইং সনে মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) সর্ব প্রথম হাফেজিয়া ফোরকানীয়া মাদ্রাসা হিসেবে, বর্তমান সোনাকান্দা দারুল হুদা বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা ভিত্তি স্থাপন করেন। পর্যায়ক্রমে এ মাদ্রাসাটি ১৯৫৫ ইং মোতাবেক ১৩৬২ বাংলা সনে ওল্ডস্কীম জানিয়ার তথা দাখিল পরীক্ষার মঞ্জুরী প্রাপ্ত হয়। ১৩৬৫ বাংলা সাল মোতাবেক ১৯৫৮ ইং সনে সিনিয়র ক্লাস তথা আলিম মঞ্জুরী প্রাপ্ত হয়।১৩৬৬ বাংলা মোতাবেক ১৯৬০ ইং সনে দরজায়ে ফাযেল খোলা হয় এবং সরকারী অনুমতি প্রাপ্ত হয়।

১৩৭০ বাংলা সনে ১৬ ইং ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৬০ইং সনে কামিল শ্রেণীর মঞ্জুরী লাভ হয়। কামিল শ্রেণী খোলার পর মাওলানা আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এর ইন্তেকালের (১৯৬৪) সময়ে কামিল শ্রেণীতে মাত্র সাত জন ছাত্র রেজিষ্ট্রেশন করে। এই সাত জন ছাত্র ফরম তিনি বুকে নিয়ে দুহাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে দুয়া করেন ঢাকা দারুল আবরার খানকায় মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায়। এর পর তিনি না ফেরার দেশে চলে যান (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। অতঃপর দরবার সহ মাদ্রাসার সার্বিক দায়িত্ব কাধে তুলে নেন তার বড় সাহেবজাদা দরবার শরীফের পরবর্তী গদিনাশীল পীর আবুবকর মোহাম্মদ শামছুল হুদা (রাঃ)। পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করণ সহ মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং কুতুবখানা, মুসাফির খানার সার্বিক দেখাশুনা তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে দরবার ও মাদ্রাসা কমপ্লেক্স উন্নতির দিকে নিয়ে যান। সুদীর্ঘ ৩৬ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি এ প্রতিষ্ঠানকে মহিরোহে পরিণত করেন। বিদ্যানুরাগী গদিনাশীন পীর আবুবকর মোহাম্মদ শামছুল হুদা (রাঃ) পিতার নীতি অনুসরণ করে মাদ্রাসার একাডেমিক উন্নয়নে এবং তাফসীর, ফিকহ ও আরবী সাহিত্যের উচ্চতর শিক্ষা চালু করনে উদ্যোগ নেন। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ১৯৮৮ ইং সনে কামিল ফিকহ বিভাগ অনুমতি প্রাপ্ত হয় এবং ১৯৯১ ইং সনে কামিল তাফসীর বিভাগ ও কামিল আদব বিভাগ এর অনুমতি লাভ করেন। এটি ছিল আল্লাহতালার অপার করুনা, মরহুম পীর আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এর বিশাল রূহানী দোয়া আর গদ্দিনাশীন পীর আবুবকর মোহাম্মদ শামছুল হুদা (রাঃ) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল। বর্তমানে চার বিভাগেই সফলতার সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে আগত শিক্ষার্থীরা তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও আরবী সাহিত্যে উচ্চতর জ্ঞানার্জন ও ডিগ্রী লাভের সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়াও হুজুর কেবলা বাবা ইন্তেকলের পর সাহেরা রহমান হাফেজিয়া মাদ্রাসা, কেজী নূরানী মাদ্রাসা, তাহসিল অফিস, দারুল হুদা দরবার শরীফ ও বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার মুখপত্র হিসেবে মাসিক হুদা,মাসিক মাহফীল,পত্রিকা, গবেষনাগার,বিশ্ব জাময়াত হিযবুল্লাহ আত্মশুদ্ধি মূলক অরাজনৈতিক সংগঠন, দেশে বিদেশে যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে তার অফিস সহ সমাজ সেবা মূলক অগনণিত প্রতিষ্ঠান তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার প্রতিটি জেলা,অঞ্চল,এলাকায় ও তিনি অগনণিত মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ দরবার, তালিম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ ও বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার অধীন সাহেরা রহমান হিফযখানা,কেজী নূরানী মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং, কুতুবখানা, এতিমখানা সহ সবকটি প্রতিষ্ঠান সুচারুরুপে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর ১৪/১৫ ফাল্গুন মাদ্রাসা ও দরবারের বার্ষিক ঈছালে ছাওয়াব মাহফিল, ২৯শে আর্শ্বিন হতে সাত দিন খাছছুল খাওয়াছ মাহফিল , ৫ই জৈষ্ঠ মাহফিল, মাসিক মাহফিল, বছরের বরকতময় দিনগুলোর মিলাদ কিয়াম মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাহফিল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন উপলক্ষ্যে দেশ বিদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি ও আলিম ওলামাগণ এ মাদ্রাসা ও দরবারে আগমন করে এবং প্রতিষ্ঠানকে উৎসব মুখর করে তুলেন এবং এখনো তা অব্যাহত আছে।

** হাফেজ আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) এর সহায়তায় ও নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহঃ

হাফেজ আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) নিজ উদ্যোগে তাঁর নিজ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভক্তবৃন্দ ও মুসলিম জনতাকে দ্বীন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর প্রেরণা ও সহায়তায় অনেক প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিমূড়া রহমানীয়া ফাযিল মাদ্রাসা, হবিগঞ্জ, বাহুবল। পূবাইল রাহমানীয়া দাখিল মাদ্রাসা, চকবাজার, কুমিল্লা। গাজীমুড়া আলিয়া মাদ্রাসা। পরমতলা ফাযিল মাদ্রাসা, মুরাদনগর, কুমিল্লা। শ্রীকাইল ডিগ্রী কলেজ পুনঃ চালুকরন। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ছাড়াও হাফেজ আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক মাদ্রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও হাফেজ আব্দুর রহমান হানাফী (রাঃ) অগণিত ইলমে তাসাউফ চর্চার আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র ও মাহফ